ভ্রু প্লাক করা হারাম কেন
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ! ভ্রু ও চোখের পাপড়ি চোখকে সুরক্ষিত রাখে। ভ্রুর সৌন্দর্য বাড়াতে নারীদের কাছে ভ্রু প্লাক করা একটা ট্রেন্ড। অনেকেই প্রশ্ন তোলেন- ভ্রু প্লাক করা হারাম কেন ? ইসলামে সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ির কোন অনুমতি নেই। মহান আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের লানত তাদের উপর যারা আল্লাহর সৃষ্টি সৌন্দর্যের পরিবর্তন করে।
আজকের আর্টিকেলটি ভ্রু প্লাক করা হারাম কেন, ইসলামে কি পুরুষের ভ্রু শেপ করা যায়?, ইসলামে ভ্রু উপড়ে ফেলার শাস্তি কি?, ভ্রু কাটা কি হারাম?, ভ্রু সম্পর্কে কুরআন কি বলে? এবং স্বামীর জন্য ভ্রু প্লাক করা যাবে কিনা এর সকল বিষয়ে কুরআন ও হাদিসের আলোকে সাজানো হয়েছে।
ভ্রু প্লাক করা হারাম কেন
আর আমি অবশ্যই তাদেরকে (প্ররোচনার মাধ্যমে) নির্দেশ দেব; ফলে তারা আল্লাহর সৃষ্টি বিকৃতি করবে। [ সূরা নিসা, আয়াত : ১১৯]
ইসলামে ভ্রু উপড়ে ফেলার শাস্তি কি?
আল্লাহর অভিশাপ সেসব নারীর উপর, যারা অন্যদের শরীরে উল্কি অঙ্কন করে দেয় এবং তারা নিজেদের শরীরে উল্কি অঙ্কন করায়, যারা অন্যদের মুখের চুল-ভ্রু তুলে দেয় এবং যারা নিজেদের মুখে চুল-ভ্রু উপড়ে ফেলে, যারা সৌন্দর্যের জন্য দাঁত কেটে দাঁতের মধ্যে ফাঁক তৈরি করে এবং যারা আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে পরিবর্তন সাধন করে। [সহীহ মুসলিম : ২১২৫; আস-সুনানুল কুবরা, বাইহাকী ১৪৮৩৩]
ইসলামে ভ্রু উপড়ে ফেলে ভ্রু চিকন করার শাস্তি / নিষেধাজ্ঞা আরো বেশি কঠোর হবে, যদি তা নির্লজ্জ, ফাসেক-ফুজ্জার ও অমুসলিম নারীদের ভূষণ হিসেবে কখনো নির্ধারণ হয়ে যায়।
ভ্রু প্লাক করা হারাম এ বিষয়ে সকল ঘরনার আলেমগণ একমত পোষণ করেছেন। তবে ভ্রু ছাড়া মুখের অন্যান্য পশম ও উপড়ানো বিষয়ে আলেমদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে।
হাম্বলী মাযহাবের কিছু আলিম বলেছেন, স্ত্রীরা স্বামীর অনুমতিক্রমে ভ্রু ছাড়া মুখের অন্যান্য পশম ও উপড়ানো, পাউডার, ক্রিম ও মেহেদী ইত্যাদি মেয়েরা ব্যবহার করতে পারবে। কারণ এগুলো নারীদের স্বাভাবিক সৌন্দর্যের অংশ।
ইমাম নববী রাহিমাহুল্লাহর অবস্থান কিছুটা কঠোর মুখের পশম উপড়ানোর ক্ষেত্রে। তার মতে, মুখের পশমও উপড়ানো যাবে না। ইমাম নববী রাহিমাহুল্লাহর দৃষ্টিতে মুখের পশমও উপড়ানো ভ্রু চিকন করার শাস্তির / নিষেধাজ্ঞার আওতাভুক্ত।
তবে ইমাম আবু দাউদ রাহিমাহুল্লাহর ব্যাখ্যা তার এ কঠোর অবস্থানকে প্রত্যাখ্যান করে। ইমাম আবু দাউদ রাহিমাহুল্লাহ ভ্রু প্লাক বা ভ্রু চিকন (নামিসা) করার ব্যাখ্যায় বলেন—
আর (হাদিসে উল্লেখিত) 'নামিসা' হলো সেই নারী, যে গুরুর উপর নকশা করে তাকে চিকন করে ফেলে। [ সুনানু আবি দাউদ : ৪১৭০]
অতএব মুখের পশম উপড়ে ফেলাটা ভ্রু প্লাক বা চিকন বিষয়ক নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়বে না।
মুখের পশম উপড়ানো ভ্রু প্লাক বা চিকন বিষয়ক নিষেধাজ্ঞার আওতাভুক্ত কিনা সে বিষয়ে আরো একটি হাদিসে বর্ণনা পাওয়া যায়। হাদিসটি আবু ইসহাক রাহিমাহুল্লাহর স্ত্রী থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন—
তিনি আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহার কাছে উপস্থিত ছিলেন।তখন তাকে একজন নারী জিজ্ঞেস করল, হে উম্মুল মুমিনীন, আমার চেহারায় অনেক (অতিরিক্ত অবাঞ্ছিত) পশম আছে। আমি কি আমার স্বামীর জন্য সাজুগুজু করার উদ্দেশ্যে তা তুলে ফেলতে পারব? আয়েশা রাজিয়াল্লাহু আনহা বললেন, তোমার চেহারা থেকে এসব অবাঞ্ছিত পশম সরিয়ে ফেলো।
[মুসান্নাফু অব্দির রাজ্জাক : ৫১০৪; মুসনাদু ইবনিল জাদ : ৫৪১; হাদিসটির সনদ যইফ]
ভ্রু কাটা কি হারাম?
অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে, ভ্রুর আকৃতি পরিবর্তন না করে ভ্রুর নিচের লোম উপরে ফেলা কি জায়েজ? কারণ এই লোম একেবারে সামান্য ও ভ্রু থেকে পুরো আলাদা হয়।
ভ্রুর উপরের ও নিচের পশম ভ্রুর আওতাভুক্ত। ফলে এগুলো কাটা বা তোলা যায় হারাম।ইবনে মানযুর (রহ.) বলেন, দুই চোখের উপরের গোশত ও চুল সমেত হাড্ডিদ্বয়কে ভ্রু বলে।
ভ্রু চোখে সূর্যের রশ্মি পড়তে বাধা দেয়। ভ্রুর নিচের ও উপরের পশম ভ্রুর মূল চুল থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও তদুপরি সেটি ভ্রুর অধিভুক্ত।কারণ, সেটি কেননা, সেটি ভ্রুর হাড্ডির এলাকায় গজিয়েছে। তাই এটি ভ্রুর হাড্ডির বিধানই গ্রহণ করবে।
ইসলামের মূলনীতি অনুযায়ী, নিদেনপক্ষে এর হুকুম হলো- যে বিষয়ে সংশয় অতি তীব্র সে সকল বিষয় সতর্কতাস্বরূপ সেটি ত্যাগ করা।
স্বামীর জন্য ভ্রু প্লাক করা যাবে
ইসলামী শরীয়তে ভ্রু প্লাক করা হারাম। তাই স্বামীর জন্যও ভ্রু প্লাক করা যাবে না। স্বামী চাইলেও ভ্রু প্লাক করা ও নকশা আঁকার ব্যাপারে ইসলামের জায়েজ নেই।কেননা ভ্রু প্লাক দ্বারা আল্লাহর সৃষ্টিতে পরিবর্তন করা হয়, যা ইসলামে অনুমোদিত নয়।
আবুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন— আল্লাহ্ লানত করেছেন আল্লাহ্র সৃষ্টিকে পরিবর্তনকারী সে সব নারীদের যারা উল্কি অঙ্কনের কাজ করে, যাদের উল্কি করানো হয়, সৌন্দর্য চর্চা হিসেবে যাদের চোখের ভ্রু সরু করা হয়, যাদের দাঁত সরু করানো হয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যাকে লানত করেছেন— আমি তাকে লানত করতে বাধা কোথায়?
এটি তো আল্লাহ্র কিতাবেই রয়েছে। “রাসুল তোমাদের যা দিয়েছেন তা গ্রহণ করো”... “বিরত থাক” পর্যন্ত (সুরা হাশর, আয়াত: ০৭)।
[সহিহ বুখারি : ৫৯৩১]
আর শরীরের অন্যান্য অঙ্গের লোম যেমন হাত বা পায়ের লোম পুরুষ এবং নারীদের জন্য একেবারে উপড়ে ফেলা বা মুণ্ডন করে ফেলা নিষেধ নয়। তবে অনুত্তম।
ইসলামের বিধান লঙ্ঘন করে স্বামীকে খুশি করা শরীয়তে জায়েজ নাই। কেননা হাদিস শরীফে এসেছে- অনুগত্য কেবলই বৈধ কাজে। আল্লাহর (বিধানের) বিরুদ্ধাচারণ করে মাখলুকের অনুগত্য করা জায়েজ নাই।
স্বামীর মনোরঞ্জনের জন্যও ভ্রু প্লাক করা যাবে না। কিন্তু স্বামী যদি ভ্রু প্লাক করতে বলে। কারণ ভ্রু প্লাক করলে স্বামীর কাছে স্ত্রীকে বেশি ভাল লাগে। স্বামীর অনুমতিতে তার জন্য ভ্রু প্লাক করলে কোন পাপ হবে না।
তাহলে স্বামীকে বোঝাতে হবে যে, ইসলামের বিধানে ভ্রু প্লাক করা সম্পূর্ণ হারাম। ইসলামের বিধান লঙ্ঘন করে স্বামীকে খুশি করা শরীয়তে জায়েজ নাই। তাই আপনি কিছুতেই ভ্রুপ্লাক করবেন না।
মনে রাখতে হবে যে, আজ স্বামীর খুশি ও মনোরঞ্জনের জন্য আল্লাহর বিধান লঙ্ঘন করে ভ্রু প্লাক করলে কাল তার কারণেই আল্লাহ তায়াল আপনাকে অপামানিত করবেন। কাজেই সতর্কতা অবলম্বন জরুরী।
সুতরাং আল্লাহর বিধানের বাইরে গিয়ে কারো মন জয় করা বা আল্লাহর বিধান বহির্ভূত কাজ করে কারো আনুগত্য স্বীকার করা যাবে না। আমরা একমাত্র আল্লাহর আনুগত্য স্বীকার করব। ফেরাউনের স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও আসিয়া আল্লাহর উপর ঈমান এনেছিলেন। ফলে স্বামী ফেরাউনের অনেক অত্যাচার সহ্য করেছেন তবুও আল্লাহর বিধানকে লঙ্ঘন করেননি।
ইসলামে কি পুরুষের ভ্রু শেপ করা যায়?
নারীদের মুখের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে ভ্রু প্লাক করা বা ভ্রু কেটে নকশা করা বা ভ্রু চিকন করা একটি ট্রেন্ড। বর্তমানে নারীদের পাশাপাশি পুরুষের ভ্রু শেপ বা ভ্রু প্লাক করতে দেখা যায়।
ইসলামে আল্লাহ প্রদত্ত সৃষ্টির বিকৃতি করা হারাম। আর ভ্রু প্লাক করা চেহারা বিকৃতির একটি অংশ। তাই ভ্রু প্লাক করার বিধান নারী পুরুষ উভয়ের জন্য সমান।আল্লাহ প্রদত্ত সৃষ্টির বিকৃতিকারীর উপর আল্লাহ ও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অভিশাপ রয়েছে।
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলে— যে নারী পরচুলা লাগানোর কাজ করে, আর যে নারীকে পরচুলা লাগানো হয়; যে ভ্রু প্লাক বা সরু করানোর কাজ করে, যার ভ্রু প্লাক বা সরু করানো হয়, যে উল্কি অঙ্কনের কাজ করে এবং যাকে উল্কি করানো হয়— কোন রোগ ছাড়া; তাদের অভিশাপ করা হয়েছে।
[সুনানে আবু দাউদ : ৪১৭০; ফাতহুল বারি : ১০/৩৭৬]
এই হাদিসে শুধু নারীদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, কারণ তখনকার আরবের শুধুমাত্র নারীরা ভ্রু প্লাক করত। বর্তমানে পুরুষেরা নারীদের মতো ভ্রু প্লাক করছে।তাছাড়াও পুরুষের নারীদের মতো সাজসজ্জা করা এবং নারীদের বেশভূষা বহন করা সম্পূর্ণ হারাম।নারীদের মতো বেশভূষাধারী পুরুষের উপর আল্লাহর অভিশাপ।
শরীয়তের বিধানে ভ্রু প্লাক করা হারাম তো বটেই মেডিকেল সাইন্সেও এর ব্যাপক ক্ষতিকর দিক রয়েছে। ভ্রু প্লাক করলে চোখের ওপর চাপ পড়ে। সেই চাপ থেকেই ভ্রু প্লাকের সময় চোখ দিয়ে পানি ঝরে, যা চোখের ক্ষতি করে।
তাছাড়া জোর দিয়ে বার বার ভ্রু প্লাকের ফলে চোখের দৃষ্টিশক্তি কমে যায়। ভ্রু প্লাক করার সময় সুতোর চাপে চোখের ওপরের ত্বকে প্রেসার পড়ে। এতে সেই ত্বক কেটে যাওয়ারও সম্ভাবনা থাকে। অনেকে সময় ইনফেকশনও হয়। এছাড়াও ভ্রু প্লাকের সময় পাউডার ব্যবহার করা হয়। এটিও শরীরের জন্য ক্ষতিকর।
ভ্রু প্লাকের পর যাদের অ্যালার্জির সমস্যা আছে তাদের জ্বালাভাবও বেশি হয়। ভ্রু প্লাকের পর জ্বালাভাব কমাতে বিভিন্ন ধরণের ক্রিম বা লোশন দিয়ে ভ্রু ও চোখের আশপাশের ম্যাসেজ করা হয়। ফলে এর মধ্য দিয়ে চোখের ভেতরে ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
ইসলাম ভ্রু প্লাক করা হারাম করেছে। কেননা আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন সবচেয়ে সুন্দর আকৃতি দিয়ে।তাই আমাদের দেহের মালিক আল্লাহ। ক্ষণস্থায়ী এই পৃথিবীতে শরীর ও সৌন্দর্য মহান আল্লাহ আমাদেরকে আমানত হিসেবে দান করেছেন।
আল্লাহ প্রদত্তই সৌন্দর্যকে কৃত্রিম উপায়ে বিকৃতি করা এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষতি হয় এমন যেকোনো কাজই কঠিন গুনাহের কাজ এবং গর্হিত কাজ। একে তো ইসলামে ভ্রু প্লাক করা হারাম তার উপর রয়েছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি। তাই ভ্রু প্লাক হতে সকলকে বিরত থাকতে হবে। মহান আল্লাহ সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন।