পাহাড় সমান ঋণ থেকে মুক্তির দোয়া কি

আসসালামু আলাইকুম। আল্লাহ আমাদের রিজিকদাতা। তবে আল্লাহ তা'আলা বলেছেন আমাদেরকে সেই রিযিকের সন্ধান করতে। আর এই রিজিকের অন্যতম প্রধান অংশ হলো নগদ অর্থ অর্থাৎ টাকা। আমরা অনেক সময় সংসার পরিচালনা করতে গিয়ে অনেকটা ঋণ করে ফেলি।অনেক সময় আমরা ঋণ করতে করতে পাহাড় সমান ঋণের বোঝা মাথায় চেপে বসে। রাসুল (সা.) আমাদের পাহাড় সমান ঋণ থেকে মুক্তির দোয়া শিখিয়েছেন। আজকে আর্টিকেল আমরা সাজিয়েছি পাহাড় সমান ঋণ থেকে মুক্তির দোয়া কি এ বিষয়ে। 



পাহাড় সমান ঋণ থেকে মুক্তির দোয়া কি



পাহাড় সমান ঋণ থেকে মুক্তির দোয়া কি

মুমিন ব্যক্তি যেন অর্থের অপচয় করে ঋণগ্রস্থ না হয় সে ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা নির্দেশ দিয়েছেন। মুমিনদেরকে আল্লাহ তাআলা খরচের ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনের সূরা বনী ইসরাইল এর ২৬ ও ২৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন , ' আর কিছুতেই অপব্যয় করোনা। নিশ্চয়ই অপব্যয় কারীরা শয়তানদের ভাই। আর শয়তান তার রবের প্রতি খুবই অকৃতজ্ঞ। '


আল্লাহতালা মুমিনদেরকে তাদের সম্পদের একটি অংশ দান করতে বলেছেন। তিনি আরো বলেন উপার্জনের কিছু অংশ দান করলে কেউ অভাবগ্রস্থ হবে না, এই ভারসাম্য ও সমতার কারণে মুমিন কখনো ঋণের দ্বারস্থ হবে না। 


কোন মুমিন যদি প্রয়োজনে ঋণ গ্রহণ করে পরিশোধের নিয়তে কিন্তু ঋণ পরিশোধে অপারগ হয় তাহলে আল্লাহ তাআলা তার পক্ষ থেকে ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা করে দেন। পাহাড় সমান ঋণ থেকে মুক্তির দোয়া বিষয়ে হাদিসে এসেছে-


ঋণ পরিশোধে অপারগ এক ব্যক্তি ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু এর কাছে এসে কিছু সাহায্য চাইলেন। তখন হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু তাকে বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে কয়েকটি শব্দ শিখিয়ে দিয়েছিলেন, আমি কি তোমাকে সেটা শিখিয়ে দেব? যা পাঠ করলে আল্লাহ তোমার ঋণ মুক্তির দায়িত্ব নিবেন। তোমার ঋন যদি পাহাড় সমান হয়, তাহলেও। 


এরপর হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু পাহাড় সমান ঋণ থেকে মুক্তির দোয়ার কথাগুলো ওই ব্যক্তিকে শিখিয়ে দিলেন। পাহাড় সমান ঋণ থেকে মুক্তির দোয়া—


পাহাড় সমান ঋণ থেকে মুক্তির দোয়া আরবি, উচ্চারণ এবং বাংলা অর্থসহ নিম্নে দেওয়া হল—


اللَّهُمَّ اكْفِنِي بِحَلاَلِكَ عَنْ حَرَامِكَ، وَأَغْنِنِي بِفَضْلِكِ عَمَّنْ سِوَاكَ


উচ্চারণ : আল্ল-হুম্মাকফিনী বিহালা-লিকা আন হার-মিক, ওয়া আগনিনী বিফাদ্বলিকা 'আম্মাং সিওয়া-ক।


অর্থ : হে আল্লাহ, আপনার দেওয়া হালাল রিজিকের সাহায্যে আমাকে হারাম থেকে রক্ষা করুন এবং আপনি ছাড়া অন্যদের দয়া-দাক্ষিণ্য থেকে আমাকে স্বনির্ভরতা দান করুন আপন অনুগ্রহে। [ তিরমিজি : ৩৫৬৩]



ঋণ মুক্তির দোয়া আরবি 

সহীহুল বুখারীর বর্ণনায় পাহাড় সমান ঋণ থেকে মুক্তির দোয়া এবং  দুশ্চিন্তা ও ঋণ থেকে মুক্তি লাভের দোয়া আরবি, উচ্চারণ এবং বাংলা অর্থসহ নিম্নে দেওয়া হল—


اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْهَمِّ وَالْحَزَنِ، وَالْعَجْزِ وَالْكَسَلِ، وَالْبُخْلِ وَالْجُبْنِ، وَضَلَعِ الدَّيْنِ وَغَلَبَةِ الرِّجَالِ


উচ্চারণ : আল্ল-হুম্মা ইন্নী আ'ঊযু বিকা মিনাল হাম্মি ওয়াল হাঝানি, ওয়াল 'আজঝি ওয়াল-কাসাল, ওয়াল-বুখলি ওয়াল-জুবনি, ওয়া দ্বলা'য়িদ্দাইনি ওয়া গলাবাতির রিজা-ল।


অর্থ : হে আল্লাহ, আমি আপনার আশ্রয় চাইছি দুশ্চিন্তা ও দুঃখ দুর্দশা থেকে, অক্ষমতা ও অলসতা থেকে, কৃপণতা ও ভীরুতা থেকে এবং ঋণের গঞ্জনা ও মানুষের দমন-পীড়ন থেকে। [সহীহুল বুখারী : ২৮৯৩]



ইসলামে ঋণ নিয়ে মৃত্যু হলে কি হয়?

ইসলামে ঋণ নিয়ে মৃত্যু হলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন না। যদি কোন ব্যক্তি ঋণগ্রস্থ অবস্থায় শহীদ হন তবুও তার ঋণের গুনাহ আল্লাহ ক্ষমা করবেন না।রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঋণ গ্রহণের চারিত্রিক সমস্যার কথাও স্পষ্ট করে দিয়েছেন।  


রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যার ব্যাপারে জানতেন যে, সে ঋণগ্রস্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে এবং পরিশোধের ব্যবস্থাও করে যায়নি, তার জানাজা তিনি পড়াতেন না। এটা তিনি এ কারণে করতেন যেন মানুষ ঋণকে ভয় পায়। তবে পরবর্তী সময়ে গনিমত ও যুদ্ধলব্ধ সম্পদ আসা শুরু হলে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই ঋণ পরিশোধ করে দিতেন। 

[ সহীহুল বুখারী : ২২৯৮; সহীহ মুসলিম : ১৬১৯]


ইসলামে ঋণ নিয়ে মৃত্যু হলে কি হয় এ বিষয়ে আব্দুল্লাহ ইবনু আমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন, ' ঋণ ব্যতীত শহীদের সকল গুনাহই ক্ষমা করে দেওয়া হয়। [সহীহ মুসলিম : ১৮৮৬; মুস্তাদরাকুল হাকিম : ২৫৫৪]


প্রতিটি মুমিন ব্যক্তির জন্য এই হাদিস থেকে নির্দেশনা হলো যে, খুব প্রয়োজন না হলে ঋণ নেওয়া যাবে না ;  ঋণ গ্রহণ করলেও তা পরিশোধের  নিয়তে গ্রহণ করতে হবে এবং মৃত্যুর পূর্বে ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা করে যেতে হবে। 



 দুশ্চিন্তা ও ঋণ থেকে মুক্তি লাভের দোয়া

ঋণ আমাদের খাওয়া ঘুম হারাম করে দেয়। ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি সর্বদা দুশ্চিন্তায় ডুবে থাকে এবং তার মাথার উপর বোঝা হয়ে চেপে বসে। আমাদের এরকম পরিস্থিতি থেকে মুক্তি লাভের জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দোয়া শিখিয়েছেন। 


রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঋণকে খুব অপছন্দ করতেন। কেননা, ঋণ মানেই হলো দুশ্চিন্তা ও বোঝা।  রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঋণের বোঝা থেকে মুক্ত থাকার জন্য সবসময় আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন। 


উচ্চারণ : আল্ল-হুম্মা ইন্নী আ'উযু বিকা মিন গলাবাতিদ দাঈন। 

অর্থ : হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে ঋণের প্রাবল্য থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। 



ইসলামে ঋণ কি হারাম?

অনেকে সুদভিত্তিক ঋণ কিংবা সুদমুক্ত ঋণ গ্রহণ করে থাকি। কিন্তু ইসলাম বলে সুদের সাথে যে কোন ভাবে যুক্ত থাকা বড় গুনাহ। ইসলামে সুদ ভিত্তিক ঋণ স্পষ্টভাবে হারাম।


ঋণ হলো কুফরের সমান। ঋণগ্রস্থ ব্যক্তি ঋণ পরিশোধ করতে দেরি হলে কিংবা অপারগ হলে অধিকাংশ সময় মিথ্যে কথা বলে এবং ওয়াদা দিয়ে তা ভঙ্গ করে। আবু সাঈদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, ' আমি কুফর ও ঋণ হতে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করছি।' তখন এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি ঋণ কে কুফরের সমপর্যায়ের বিষয় মনে করছেন? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, 'হ্যাঁ।' [ সুনানুন নাসায়ি : ৫৪৭৩; মুসনাদু আহমাদ : ১১৩৩৪]



রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাজ পড়ার সময় আল্লাহর কাছে গুনাহ ও ঋণ হতে আশ্রয় চাইতেন। আয়শা রাদি আল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাজের মধ্যে -


'আল্ল-হুম্মা ইন্নী আ'ঊযু বিকা মিনাল মা'সামি ওয়াল মাগরম' অর্থাৎ হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে গুনাহ ও ঋণ হতে পানাহ চাই  -এই দোয়া করতেন। 


তখন একজন প্রশ্নকারী তাকে জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি ঋণ হতে এত বেশি আশ্রয় প্রার্থনা করেন কেন? তিনি বললেন, ' কোন ব্যক্তি যখন ঋণগ্রস্ত হয়, তখন সে কথা বললে মিথ্যা বলে এবং ওয়াদা করলে তা ভঙ্গ করে। 

[ সহীহুল বুখারী : ২৩৯৭; সহীহ মুসলিম : ৫৮৯]


তাই প্রকৃত মুমিন সুদমুক্ত ঋণও গ্রহণ করতে চায় না; তারা সব সময় চেষ্টা করে ঋণমুক্ত থাকার। এবং ঋণ মুক্ত থাকার জন্য সর্বদা আল্লাহর কাছে দোয়া করে।কোন বিশ্বাসী মুমিন ব্যক্তির জন্য সেখানে সুদভিত্তিক ঋণ গ্রহণ করা তাদের জন্য অসম্ভব। 


সুদ ভিত্তিক ঋণের সাথে জড়িত সকল ব্যক্তির উপর আল্লাহর লানত। আল্লাহ তাআলা ব্যবসাকে হালাল এবং সুদকে হারাম করেছেন। সূরা বাকারায় আল্লাহ তায়ালা ব্যবসা এবং সুদ এর সম্পর্কে বলেছেন।আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল এবং সুদকে হারাম করেছেন সুরা বাকারা ২৭৫ নম্বর আয়াতে। 


তবে প্রয়োজনে ঋণ পরিশোধের নিয়তে সুদমুক্ত ঋণ গ্রহণ করা যাবে। এ সম্পর্কে হাদিসে এসেছে আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি পরিশোধের নিয়তে মানুষের সম্পদ (ঋণ হিসেবে) গ্রহণ করে আল্লাহ তার পক্ষ থেকে পরিশোধের ব্যবস্থা করে দেন। আর যে ব্যক্তি বিনষ্ট করার নিয়তে তা গ্রহণ করে, আল্লাহ তাআলা তাকে ধ্বংস করেন। 

[ সহীহুল বুখারী : ২৩৮৭ ; মুসনাদু আহমাদ : ৮৭৩৩]



সুতরাং প্রতিটি মুমিন মুসলমানের কর্তব্য হলো সর্বদা ঋণ মুক্ত থাকা। আর যদি খুব প্রয়োজন হয় ঋণ করার তাহলে অবশ্যই সুদ মুক্ত ঋণ গ্রহণ করতে হবে এবং ঋণ পরিশোধের নিয়তে তা গ্রহণ করতে হবে। এবং আমাদের সর্বদা ঋণ মুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতে হবে। 


কেউ যদি পাহাড় সমান ঋনে ডুবে যান তাহলে অবশ্যই তাকে পাহাড় সমান ঋণ থেকে মুক্তির দোয়া করে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতে হবে। আল্লাহ নিশ্চয়ই মুমিন ব্যক্তিদের পাহাড় সমান ঋণ মুক্তির দোয়া কবুল করবেন। ইনশাআল্লাহ!

Next Post Previous Post