ঈদে মিলাদুন্নবী সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য || নবীজির জন্মদিন পালন করা যাবে কি?
আসসালামু আলাইকুম। আজকে আর্টিকেলে ঈদে মিলাদুন্নবী সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য এর মধ্যে নবীজির জন্মদিন পালন করা যাবে কি? , ঈদে মিলাদুন্নবী কখন থেকে চালু হয়? এবং জন্মদিন পালন করা নিয়ে হাদিস অর্থাৎ ঈদে মিলাদুন্নবী সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখবো, ইনশাআল্লাহ।
ঈদ হল মুসলমানদের সবচেয়ে বড় একটি উৎসব। এই দিনে মুসলমানরা খুব সকালবেলা মিষ্টিমুখ করে সালাত আদায়ের উদ্দেশ্যে ঈদগাহে যায় এবং সেখানে উৎসবমুখর পরিবেশে সালাত আদায় করে থাকে। আর মুসলমানদের জন্য ঈদ হল দুইটি। ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আযহা। হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর জন্মদিন উপলক্ষে ঈদের মিলাদুন্নবী নামে কিছু মুসলিম যে উৎসব পালন করে থাকেন তার কোন বিধান ইসলামে নেই।
ঈদে মিলাদুন্নবী সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। ইসলামের বিধানে কোন কাজটি করণীয় এবং কোন কাজটি বর্জনীয় সে বিষয়ে আল্লাহ ও তার রাসূল (সাঃ) এর পক্ষ থেকে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। তবুও দৈনন্দিন জীবনে আমরা শিরক ও বিদআত এর মধ্য দিয়ে জীবনকে উৎসবমুখর করে তুলি।
আল্লাহ তাআলা আমাদের দ্বীন ইসলামকে নবীর জীবদ্দশাতেই পূর্ণাঙ্গ করে দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনের সূরা মায়েদার ৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহতালা বলেছেন, 'আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের ধর্ম রূপে মনোনীত করলাম।'
ঈদে মিলাদুন্নবী হল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মদিন উপলক্ষে ১২ই রবিউল আউয়াল তারিখে ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করা হয়। অথচ নবীজি (সাঃ) এর জন্মের বছর সম্পর্কে স্পষ্ট ভাবে জানা গেলেও তার জন্মের তারিখ সম্পর্কে স্পষ্ট কিছু জানা যায় না। নবীজি (সাঃ) এর জন্মের প্রসিদ্ধ তারিখ ১২ই রবিউল আউয়াল হলেও এ বিষয়ে মতভেদ রয়েছে।
তবে নবীজি (সাঃ) এর জন্মবার নিয়ে কোন মতভেদ নেই। সিরাত ও ইসলামী ইতিহাসের পণ্ডিতরা এই বিষয়ে একমত যে , রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐতিহাসিক হস্তির বছর আরবী রবিউল আউয়াল মাসের কোন এক সোমবার ভোরবেলা, সুবহে সাদিকের কিছুক্ষণ আগে জন্মগ্রহণ করেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের জন্মদিন উপলক্ষে কোন উৎসব, মিছিল কিংবা খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করতেন না। রাসূল সাঃ তার জন্ম বার সোমবার শুকরিয়া স্বরূপ রোজা রাখতেন। তাই এই দিনে রোজা রাখা মুস্তাহাব।
ঈদ হল মুসলমানদের পালনীয় সবচেয়ে বড় একটি উৎসব। মুসলমানদের ঈদ হল মাত্র দুটি। একটি ঈদুল ফিতর অন্যটি ঈদুল আযহা। এই দুটি ঈদ ব্যতীত ইসলামের তৃতীয় আর কোন ঈদ নেই। কিন্তু কিছু মুসলমান নবীজির জন্মদিন কে তৃতীয় ঈদ হিসেবে উৎসবমুখর পরিবেশে পালন করে আসছেন; যা সম্পূর্ণ বিদআত।
হাদিসে এসেছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি আমাদের এই দ্বীনের ভেতর এমন কিছু আবিষ্কার করে, যা তার অন্তর্ভুক্ত নয়, তবে তা প্রত্যাখ্যাত। [ বুখারী ও মুসলিম]
অন্য এক বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন, তোমরা দ্বীনের মধ্যে নতুন সৃষ্টি করা হতে সাবধান থাকো। নিশ্চয়ই প্রত্যেক নতুন সৃষ্টিই বিদআত ও প্রত্যেক বিদআতই পথভ্রষ্টতা । [ আবু দাউদ : ৬৪০৭ ; মিশকাত : ১৬৫]
সবচেয়ে বড় কথা হলো আমাদের উৎসবের যে দুইটি ঈদ রয়েছে তাতে ঈদগায়ে যে নামাজ আদায় করা হয় কিন্তু এই ঈদে কোন নামাজ নেই। নবীজি এই ঈদের কথা জানতেন না। নবীজির সাহাবীগণ, তাবিঈ এবং তাবে-তাবিঈ কেউই এই ঈদের বিষয়ে জানতেন না। এছাড়াও খোলাফায়ে রাশেদীনের কেউ এবং তারা কখনো ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করেননি। অথচ আমাদের দেশসহ উপমহাদেশের মুসলিমরা খুব ঘটা করে ১২ই রবিউল আউয়াল নবীজির জন্মদিন উপলক্ষে ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করে থাকে।
ঈদে মিলাদুন্নবী অর্থাৎ নবীজির জন্মদিন পালন করা বিদআত। এ বিষয়ে চার মাযহাবের সকল আলেম একমত পোষণ করেছেন।
নবীজির জন্মদিন পালন করা যাবে কি?
নবীজির জন্মদিন পালন করা বিদআত।নবীজি (সাঃ) তার জীবদ্দশায় কখনো জন্মদিন পালন করেননি। তবে নবীজি (সাঃ) তার জন্মবার উদযাপন করতেন। তার জন্মবার ছিল সোমবার। সে উপলক্ষে নবীজি রোজা রাখতেন। তাই মুসলমানদের সোমবার রোজা রাখা মুস্তাহাব।
এ বিষয়ে হযরত আবু কাতাদাহ আনসারী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু সাল্লাম কে সোমবার রোজা রাখা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, 'ঐদিন আমি জন্মগ্রহণ করেছি, ওই দিনই আমি নবুওয়াত লাভ করেছি... ।' [ সহীহ মুসলিম : ১১৬২]
জন্মদিনের সূচনা হয় ফেরাউন থেকে। বাইবেলের বুক অফ জেনেসিসে এসেছে, 'তৃতীয় দিনটা ছিল ফেরাউনের জন্মদিন। ফেরাউন তার সব দাসদের জন্য ভোজের আয়োজন করলেন। সেই সময় ফেরাউন রুটি ওয়ালা ও খাদ্যদ্রব্য পরিবেশক কে কারাগার থেকে মুক্তি দিলেন।[ আদি পুস্তক : ৪০২]
ঈদে মিলাদুন্নবী কখন থেকে চালু হয়?
ঈদে মিলাদুন্নবী সর্বপ্রথম মুজাফফরুদ্দীন কুকুবুরী ৬০৪ হিজরী মতান্তরে ৬২৫ হিজরীতে মিলাদের প্রচলন চালু করেন। এটি ছিল নবীজী সাঃ এর মৃত্যুর প্রায় ৫৯৩ / ৬১৪ বছর পরে। মুজাফফরুদ্দীন কুকুবুরী কে ত্রুসেডারদের বিরুদ্ধে বিজয়ী মহান মুজাহিদ সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবী ইরাকের এরবল এলাকার গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন।
মিলাদের প্রচলন চালু করার প্রথম দিকে এই দিনটিতে তারা শুধুমাত্র নবীজির জন্ম ও জীবন কাহিনী স্মরণ করতেন এবং লোকজনের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। তবে তখনকার মিলাদে কিন্তু বর্তমানের মত নবীর রূহের আগমন কল্পনা করে তার সম্মানে উঠে দাঁড়িয়ে 'ইয়া নবী সালামু আলাইকা' বলে দরুদে শান পড়া কিংবা জিলাপি বিতরণের মত কোন মিলাদ মাহফিল হতো না।
তখনকার ছোট্ট একটি বিদআত ধীরে ধীরে বিশাল আকার ধারণ করে প্রমাণ নয় 'ঈদে মিলাদুন্নবী' নামক তৃতীয় ঈদে পরিণত হয়েছে।বিদআতি সুফিদের ধারা বিভিন্ন শিরকি আকিদাও ধীরে ধীরে এর সাথে যুক্ত হয়েছে। বিদআতি সুফিদের ধারণা এই যে, মাহফিলের সময়ে নবীজির রুহ মোবারক সেখানে হাজির হয়। [নাউজুবিল্লাহ] এটি খ্রিস্টানদের বাইবেল থেকে ধার করা একটি আকিদা। খ্রিস্টানরা তাদের নবীর উপর এমন মিথ্যা আরোপ করেছিল।
আমাদের দেশে দু'ধরনের মিলাদ চালু আছে। একটি হল কিয়াম (দাঁড়ানো) যুক্ত অর্থাৎ তারা রাসূলের সম্মানে উঠে দাঁড়িয়ে থাকেন। তাদের ধারণা মিলাদের মাহফিলে নবীজী সাঃ এর রুহ মোবারক হাজির হয়। যা সর্বসম্মতি ভাবে কুফরি। অন্যটি হলো কেয়ামবিহীন।
তবে ঈদে মিলাদুন্নবী অর্থাৎ নবীজির জন্মদিন উপলক্ষে প্রচলিত মিলাদ অনুষ্ঠান বিদআত এ ব্যাপারে চার মাজহাবের মধ্যে দ্বিমত নেই। আহলে হাদিস আলিমগণ সকলে এক বাক্যে প্রচলিত মিলাদ অনুষ্ঠানকে বিদআত ও গুনাহের কাজ বলেছেন।
হানাফী মাযহাবের কিতাবে বলা হয়েছে, ' যে ব্যক্তি ধারণা করে যে, মৃত ব্যক্তিদের রুহু হাজির হয়ে থাকে, সে ব্যক্তি কাফের'।[ মিলাদে মুহাম্মাদি, পৃষ্ঠা : ২৫,২৯]
অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, যারা ধারণা করে যে, মিলাদের মজলিসগুলোতে নবীজি সাঃ এর রুহ মোবারক হাজির হয়ে থাকে, তাদের এই ধারণা স্পষ্ট শিরক।
নবীজি (সাঃ) তার জীবদ্দশায় তার সম্মানার্থে উঠে দাঁড়ানোর বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ার প্রদান করেছেন।[ তিরমিজি; মিশকাত; আবু দাউদ]
জন্মদিন পালন করা নিয়ে হাদিস
নবীজির জন্ম বছর স্পষ্ট হলেও জন্ম তারিখ নিয়ে মতামত রয়েছে।১২ই রবিউল আউয়াল জন্ম তারিখ প্রসিদ্ধ হলেও এ ব্যাপারে আলেমরা দ্বিমত পোষণ করেছেন। তবে নবীজির ওফাত অর্থাৎ মৃত্যু তারিখ নিয়ে কারো মতবিরোধ নেই। ১২ই রবিউল আউয়াল নবীজি ইন্তেকাল করেন এ বিষয়ে সকলে একমত। সে দিক দিয়ে এ দিনটি শোকের দিন।
তবে সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈনরা তাদের যুগে কখনোই ১২ই রবিউল আউয়াল তারিখে ঈদে মিলাদুন্নবী বা খুশির দিবস হিসেবে কিংবা শোক দিবস হিসেবে পালন করেননি। নবীজির জীবদ্দশায়ও তিনি কখনো পূর্বের নবী ও রাসূলগণের কোন প্রকার জন্মদিন কিংবা মৃত্যুদিবস উপলক্ষে মিলাদ কিংবা খাওয়া-দাওয়া ও মিছিলের আয়োজন করেননি।
নবীজি (সাঃ) এর মৃত্যুর ৫ দিন আগে অসুস্থতা আরও বেড়ে যায়। ফলে তিনি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় তিনি বলেন, আমার শরীরে বিভিন্ন কূপের সাত মশক পানি ঢালো, যাতে আমি লোকজনদের নিকট গিয়ে উপদেশ দিতে পারি। ফলে হযরত মুহাম্মদ সাঃ কে একটি বড় পাত্রের মধ্যে বসিয়ে তার উপর, এত বেশি পরিমাণে পানি ঢালা হলো যে, তিনি নিজেই খ্যান্ত হওয়া বলতে থাকলেন। তখন তার রোগ যন্ত্রণা কিছুটা কম হয় এবং তিনি মসজিদে যান। তখনও তার মাথায় পাগড়ি বাধা ছিল।
তিনি মসজিদের মেম্বারের ওপর বসে পড়লেন এবং বললেন, ইহুদি ও নাসারাদের উপর আল্লাহর অভিশাপ বর্ষিত হোক এ জন্য , তারা তাদের নবীদের কবর সমূহ কে মসজিদ তথা সিজদার স্থান বানিয়ে নিয়েছে।তিনি আরো বলেন, তোমরা আমার কবরকে মূর্তি বানিও না এ জন্য, যে তার পূজা করা হবে।[মুয়াত্তা ইমাম মালিক, পৃষ্ঠা : ৬৫]
সুতরাং ঈদে মিলাদুন্নবী সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট যে মুসলমানদের জন্য তৃতীয় ঈদ বলতে কিছু নেই। ঈদে মিলাদুন্নবী বা নবীজির জন্মদিন পালন করা বিদআত। তাই নবীজির আদর্শ আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করতে নবীজির সুন্নাহ অনুসরণ করা আবশ্যক। আমাদের উচিত নবীজির জন্মদিন উপলক্ষে সোমবার রোজা রাখা। আল্লাহ সবাইকে হেদায়েত দান করুন এবং সঠিক দ্বীনকে বোঝার তৌফিক দান করুন, আমিন।