বদর যুদ্ধ কত হিজরীতে সংঘটিত হয়

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুসলমানদের উপর মক্কার পৌত্তলিকদের নির্যাতন এবং সংঘাতময় কর্মসূচি যখন চরম পর্যায়ে পৌঁছায় তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনা হিজরত করেন। হিজরতের পরেও  মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুরাইশদের সংঘাতময় কর্মসূচি, আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এর সাথে পত্রালাপ এবং মক্কার কুরাইশ ও মুশরিকরা মুসলমানদের উপর অত্যাচার ও নিপীড়ন নির্যাতনের পাহাড় গড়ে তুলে। মদিনার এরকম ভয়-ভীতিকর বিপদজনক অবস্থা, যা মুসলমানদের অস্তিত্বের জন্য একটি মারাত্মক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। 


মক্কার পৌত্তলিকরা কোনভাবেই তাদের বিদ্বেষে একঘোয়ামি পরিহার করতে প্রস্তুত ছিল না। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদেরকে যুদ্ধের অনুমতি প্রদান করেন। এর আগ পর্যন্ত মুসলমানদের উপর যুদ্ধ ফরজ হয়নি। এ সময় মক্কার কাফেরদের সাথে মুসলমানদের প্রথম সামরিক যুদ্ধ বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়।আজকে আর্টিকেলে বদর যুদ্ধ কত হিজরীতে সংঘটিত হয় , বদরের যুদ্ধ কোথায় সংঘটিত হয় এবং মুসলমান ও কাফেরদের সৈন্য সংখ্যা প্রভৃতি বিষয়ে সাজানো হয়েছে। 



বদর যুদ্ধ কত হিজরীতে সংঘটিত হয়



বদর যুদ্ধ কত হিজরীতে সংঘটিত হয়

ইসলামের ইতিহাসে ঐতিহাসিক মুসলমানদের প্রথম সামরিক যুদ্ধ বদর যুদ্ধ দ্বিতীয়  হিজরীতে সংঘটিত হয়। বদর যুদ্ধ ইতিহাসে গাজওয়ায়ে বদর নামেও পরিচিত। মক্কার কুরাইশদের অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে গেলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও অনন্য মুসলমানদের জীবন রক্ষার্থে ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মদিনা হিজরত করেন। এতে মুসলমানদের উপর কুরাইশদের ক্ষোভ আরো বৃদ্ধি পায় এবং মদিনা বাসীদের সাথে শত্রুতার সৃষ্টি হয়। 


ক্রমেই বিভিন্ন কারণে শত্রুতা বাড়তে থাকে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের ১৩ই মার্চ দ্বিতীয় হিজরীর ১৭ই রমজান বদর প্রান্তরে মদিনার মুসলমান ও মক্কার কাফেরদের মধ্যে ঐতিহাসিক মুসলমানদের প্রথম সামরিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যা ইসলামের ইতিহাসে ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ নামে পরিচিত। 


বদর যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার বেশ কিছু কারণ ছিল। বদর যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পূর্বে কিছু খন্ড যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। তার মধ্যে গাজওয়া অভিযান বিশেষ গুরুত্ব পূর্ণ ভূমিকা রাখে। 'আর-রাহীকুল মাখতুম' এর গাজওয়ায়ে উশায়রার  আলোচনায় উল্লেখ্য আছে , একটি কুরাইশ কাফেলা মক্কা হতে সিরিয়া যাওয়ার পথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পাকটাও হওয়ার হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিল। উক্ত কাফেলাটি যখন সিরিয়া থেকে মক্কায় ফিরে যাচ্ছিল, তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু সাঈদ ইবনু যায়েদ রাদিয়াল্লাহু আনহু কে তাদের অবস্থা ও অবস্থানের প্রতি লক্ষ রাখার জন্য উত্তর দিকে প্রেরণ করেন। তারা হাওড়া পর্যন্ত পৌঁছে সেখানে অপেক্ষায় থাকেন। 


কাফেলাটি নিয়ে আবু সুফিয়ান যখন স্থানটি অতিক্রম করছিলেন তখন সাহাবীদয় দ্রুত গতিতে মদিনায় পৌঁছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিষয়টি জানান। মক্কাবাসীদের এ কাফেলায় প্রচুর ধন-সম্পদ ছিল। এক হাজার উট এবং উট গুলো কমপক্ষে ৫০ হাজার স্বর্ণ মুদ্রা মূল্যের মালপত্র বহন করছিল। আর এগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ৪০ জন কর্মী কাফেলায় নিযুক্ত ছিল। 


এটা একটি অপূর্ব সূচক ছিল মদিনা বাসীদের ধন দৌলত লাভের। পক্ষান্তরে এ বিশাল পরিমাণ ধন-সম্পদ থেকে বঞ্চিত হওয়ার ব্যাপারটি ছিল মক্কা বাসীদের জন্য সামরিক রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এক বিরাট ক্ষতি। রাসূলুল্লাহ সাঃ ঘোষণা করে দিলেন, সিরিয়া থেকে মক্কা প্রত্যাবর্তনকারী কুরাইশ কাফেলার সাথে প্রচুর ধনসম্পদ রয়েছে। তোমরা বেরিয়ে পড়ো। হয়তো আল্লাহ গনিমত হিসেবে এ ধনসম্পদ তোমাদের হাতে দিয়ে দেবেন। 


এই অভিযান রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জরুরী বলে উল্লেখ করেননি, বরং এটাকে তিনি জনগণের ইচ্ছা ও আগ্রহের উপর ছেড়ে দেন। এই ঘোষণার সময় কেউই এটা কল্পনাও করতে পারেননি যে কাফেলার সাথে লড়াইয়ের পরিবর্তে শক্তিশালী কুরাইশ সেনাবাহিনীর সাথে বদর প্রান্তরে ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মোকাবেলা করতে হবে। যার ফলে বহু সাহাবী মদিনাতেই থেকে গিয়েছিলেন। তারা ধরে নিয়েছিলেন, এ অভিযান পূর্ববর্তী অভিযানগুলোর মতোই সাধারণ। এজন্যে যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি তাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ উত্থাপিত হয়নি। 



বদরের যুদ্ধ কোথায় সংঘটিত হয়

৬২৪ খ্রিস্টাব্দে, দ্বিতীয় হিজরীতে আরবের মদিনা হতে প্রায় ১৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বদর নামক প্রান্তরে ঐতিহাসিক বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধটি বদর নামক প্রান্তরে সংঘটিত হওয়ায় এটি বদর যুদ্ধ নামে পরিচিত। ইসলামের ইতিহাসে ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধকে গাজওয়ায়ে বদর ও বলা হয়। বদর একটি বাণিজ্য কেন্দ্রের নাম। এখানে পানির প্রাচুর্য থাকায় স্থানটির সর্বাধিক গুরুত্ব ছিল। 



বদর যুদ্ধে মুসলমান ও কাফেরদের সংখ্যা কত ছিল

স্বয়ং হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেতৃত্বে বদর প্রান্তরে অভিযানের জন্য অগ্রসর হওয়ার প্রস্তুতি নেন মুসলমানরা। বদর যুদ্ধে মুসলমান সৈন্য সংখ্যা ছিল ৩ শতাধিক। তিন শতাধিক বলতে সংখ্যাটি হতে পারে - ৩১৩, ৩১৪, ৩১৭ কিংবা ৩২৪ জন। তবে  প্রসিদ্ধ মতে বদর যুদ্ধে মুসলমান সৈন্য সংখ্যা ছিল ৩১৩ জন। এদের মধ্যে মুজাহিদ ছিলেন ৮২/৮৩/৮৬ জন। এবং অন্য বাকিরা ছিল আনসার। আনসারদের মধ্যে আউস গোত্রের ছিলেন ৬১ জন এবং খাজরাজ গোত্রের ছিলেন ১৭০ জন। 


মুসলিম বাহিনীর ৩১৩ জনের জন্য ছিল মাত্র দুটি ঘোড়া। এর একটি জুবায়ের ইবনে আউওয়াম রাদিয়াল্লাহু আনহুর এবং অন্যটি মিকদাদ ইবনু আসওয়াদ কিন্দী রাদিয়াল্লাহু আনহুর ছিল। উটের সংখ্যা ছিল ৭০ টি। উট প্রতি বরাদ্দ ছিলেন দুই থেকে তিনজন পালাক্রমে আরোহনকারী। রাসূলুল্লাহ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং মারাসাদ  ইবনু আবি মারসাদ গানাভি রাদিয়াল্লাহু আনহু এর জন্য একটি উট বরাদ্দ ছিল। 


অন্যদিকে মক্কার কুরাইশ বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন আবু জাহেল ইবনে হিসাম হিশাম। তিনি ছিলেন সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক।শুরুর দিকে কুরাইশ সেনাবাহিনীর সংখ্যা ছিল ১৩ শত। এছাড়া ১ শত ঘোড়া ও ৬ শত লৌহবর্ম  এবং অসংখ্য উট ছিল।মক্কার কুরাইশ বাহিনীর রসদপত্রের দায়িত্বে ছিল নয়জন সম্ভ্রান্ত কুরাইশ।তাদের প্রতি কাফেলার খাদ্যের জন্য কোনদিন নয়টি এবং কোনদিন দশটি উট জবেহ করত।  


বদর যুদ্ধে উল্লেখযোগ্য অলৌকিক ঘটনার মধ্যে একটি ছিল মহান আল্লাহ তালার পক্ষ থেকে মুসলমানদের সাহায্যর জন্য ৫ হাজার ফেরেশতা প্রেরণ করা। বদর যুদ্ধের অবস্থা তুলে ধরে এ  সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে সূরা ইমরান এর ১২৩ নং আয়াতে  আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করেছিলেন বদর যুদ্ধে, যখন তোমরা খুবই দুর্বল ছিলে।' 



বদরের যুদ্ধে মুসলমানদের সেনাপতি কে ছিলেন

বদরের যুদ্ধে মুসলমানদের সেনাপতি ছিলেন স্বয়ং হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেতৃত্বেই বদর প্রান্তরে ইসলামের প্রথম শক্তিশালী ও রক্তক্ষয়ী সামরিক যুক্ত সংঘটিত হয়। মুসলমানরা কম সংখ্যক সেনাবাহিনী নিয়ে কাফেরদের বিশাল বাহিনীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়।  বদর যুদ্ধে প্রথম দিকে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় দুই দলই সমান অবস্থানে থাকলেও এ যুদ্ধে মুসলিমরা বিজয়ী হয়। 



বদরের যুদ্ধে কুরাইশদের সেনাপতি কে ছিলেন

বদরের যুদ্ধে কুরাইশদের সেনাপতি ছিলেন আবু জাহল ইবনু হিশাম। আবু জাহল ইবনু হিশাম মক্কার কুরাইশ সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন। মক্কার কুরাইশ বাহিনীর রসদপত্রের দায়িত্বে ছিল নয়জন সম্ভ্রান্ত কুরাইশ। তাদের প্রতি কাফেলার খাদ্যের জন্য কোনদিন নয়টি এবং কোনদিন দশটি উট জবেহ করত। 



বদর যুদ্ধে কতজন সাহাবী শহীদ হন

দ্বিতীয় হিজরীতে সংঘটিত বদর যুদ্ধে ১৪ জন সাহাবী শহীদ হন। বদর প্রান্তরে তিন দিন যুদ্ধ শেষে কুরাইশ বাহিনী পরাজিত হয়ে পালিয়ে যায়। বদর যুদ্ধে মক্কার কুরাইশদের নেতা আবু জেহেল সহ ৭০ জন নিহত হয় এবং ৭০ জন বন্দি হন। 


বদর প্রান্তরে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর শহীদ মুসলিমদের কে যুদ্ধক্ষেত্রে দাফন করা হয়। মক্কার কুরাইশ বাহিনীর নিহতদের লাশ ময়দানের একটি কুয়ায় নিক্ষেপ করা হয়। এ সময় ২৪ জন প্রধান কুরাইশ নেতার দাস নিক্ষেপ করা হয়েছিল। তখনকার আরবের রীতি অনুযায়ী যুদ্ধক্ষেত্রে তিনদিন অবস্থান করার পর মুসলমানরা মদিনায় ফিরে আসেন।


মক্কার কয়েকজন কুরাইশ নেতাসহ ৭০ জন বন্দী হন। মুসলিমরা বন্দীদের সাথে সদ্ব্যবহার করেন এবং নিজেরা খেজুর খেয়ে বন্দীদের রুটি খেতে দিতেন। বন্দিদের সাথে করণীয় সম্পর্কের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করেন। এ সবাই হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু মত প্রকাশ করেন যে, বন্দিদের সবাই মুসলিমদেরই ভাই কই বংশের সদস্য অথবা আত্মীয়। তাই তাদের কাছ থেকে কিছু মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেওয়া উচিত যাতে মুসলিম এবং মন্দিররা পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণের সুযোগ পায়। 


রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর মতকে গ্রহণযোগ্যতা দিয়ে মুক্তিপণের বিনিময়ে বন্দীদের ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বন্দিদের মুক্তিপণের জন্য এক হাজার থেকে চার হাজার দিরহাম পর্যন্ত নির্ধারণ হয়। মুত্তালিব ইবনে হানতাব, আবু ইজজা জুমাহি ও সাইফি ইবনে আবি রিফায়াসহ কয়েকজন বন্দিকে মুক্তিপণ ছাড়াই মুক্তি দেওয়া হয়। এছাড়াও ঘোষণা করা হয় যারা পড়ালেখা জানে তারা ১০ জন নিরক্ষর মুসলিমকে শিক্ষা দিলে তা মুক্তিপণ হিসেবে গৃহীত হবে। 

Next Post Previous Post