কুরআন হাদিসের আলোকে জিলহজ্জ মাসের আমল

কিছুদিন পরে আসছে জিলহজ্জ মাস। কুরআন হাদিসের আলোকে জিলহজ্জ মাসের আমল নিয়ে আলোচনা করার আগে জিলহজ্জ মাসের আমল এতটা ফজিলতপূর্ণ কেন তা জেনে নিব। এছাড়াও জিলহজ মাসের ১০ দিন কি পড়তে হয়?, জিলহজ মাসের ১০ দিনের তাকবীর কি?, জিলহজ্ব মাসে কি কি করা যাবে না এবং কুরআন হাদিসের আলোকে জিলহজ্জ মাসের আমল কেমন হওয়া উচিত আজকে আলোচনাটি সেসব বিষয়ের ওপরে। প্রথমে ইব্রাহিম আঃ এর কোরবানির ইতিহাস সম্পর্কে জেনে নিই। 







কুরআন হাদিসের আলোকে জিলহজ্জ মাসের আমল




ইব্রাহিম আঃ এর কোরবানির ইতিহাস


জিলহজ্জ মাস বছরের পবিত্র ও মহিমান্বিত মাস। নবী ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম তখন মরুভূমির দেশ মক্কায়। একদিন স্বপ্নে তিনি আদিষ্ট হলেন প্রিয়তম পুত্র ইসমাইলকে কুরবানী করতে হবে। স্বপ্নের কথা নির্দ্বিধায় জানালেন আদরের সেই পুত্রকে।পুত্রের মুখের স্মিত হাসি। আনন্দিত কন্ঠে বলে উঠলো সে, 'বাবা, আল্লাহ আপনাকে যে হুকুম দিয়েছেন তা যথাযথভাবে পালন করুন। এ কাজে আপনি আমায় ধৈর্যশীল পাবেন। '



আমরা ধৈর্যের এক পরাকাষ্ঠা দেখতে পাই পিতা ও পুত্রের সেই ঘটনায় যা ইসলামের ইতিহাসে সুবিদিত হয়ে থাকবে চিরকাল। যদিও সেদিন ইসমাইল আলাইহিস সালামকে কুরবানী করতে হয়নি, তবে আল্লাহর নামে কুরবানী তথা পশু উৎসর্গের রেওয়াজ আমাদের ধর্ম ও সংস্কৃতির অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 



সেদিনের সেই পবিত্র ঘটনা ঘটেছিল বছরের পবিত্র মাস জিলহজ্জে। তাই জিলহজ মাসের মাহাত্ম্য, গুরুত্ব আর ফজিলত মুসলিমদের কাছে অপরিসীম। আর এ মাসেই সারা পৃথিবীর মানুষ কাবা প্রাঙ্গনে জড়ো হয় হজ সম্পাদনে। লাখো লাখো মুসল্লি অবস্থান করে মিনায়, ছুটে বেড়ায় সাফা-মারওয়ায়, পাথর ছুড়ে মারে মুজদালিফায় এবং জিয়ারত করে পবিত্র মদিনা মুনাওয়ারায়।  


আল্লাহর ঘর তাওয়াফের তৃষ্ণা যাদের অন্তরে জিইয়ে থাকে, যারা স্বপ্নের ডালা সাজিয়ে রাখে সারাটি বছর ধরে। কেবল একটিবার তারা কাবাঘরের কারো গিলাফটি ছুঁয়ে দেখতে চান। তাদের কাছে জিলহজ্জ মাস এক স্বপ্ন ছোঁয়ার মাস। 





কুরআন হাদিসের আলোকে জিলহজ্জ মাসের আমল


এই পবিত্র জিলহজ মাসকে ঘিরে আছে কিছু নির্দিষ্ট আমল, কিছু নির্দিষ্ট রীতিনীতি।  সেই আমল এবং রীতিগুলো পালনে আছে অপরিমীয় সাওয়াব। তাই কুরআন হাদিসের আলোকে জিলহজ্জ মাসের আমল নিয়ে আজকের আয়োজন।


জিলহজ মাস বছরের চারটি সম্মানিত মাসের একটি। জিলহজ মাসের ফজিলতও ব্যাপক। জিলহজ মাসের দশটি দিন এতটাই মহিমান্বিত ও বরকতময় যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা এই দিনগুলোর নামে শপথ করেছেন। 



আল্লাহ তায়ালা বলেন—  


  وَالْفَجْرِ- وَلَيَالٍ عَشْرٍۙ 


শপথ ফজরের এবং শপথ দশ রাত্রির। 

[সূরা ফরজ, আয়াত : ১-২]




তাফসীরের সবচেয়ে বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী, উক্ত আয়াতে জিলহজের ১০ দিনের নামেই আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া তা'আলা শপথ করেছেন।  আল্লাহ তায়ালা কেবল মহান ও মর্যাদাবান কোন বিষয়েই শপথ করে থাকেন। কোন বিষয়ে শপথ করার অর্থ হচ্ছে সে বিষয়টির শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করা। মহান আল্লাহ এই দিনগুলোকে বিশেষ মর্যাদা দান করেছেন বলেই সেসব রাতের নামে শপথ করেছেন। সেই সাথে তিনি 'রাত্রি' শব্দটির ক্ষেত্রে অনির্দিষ্ট বিশেষ্য ব্যবহার করেছেন; নির্দিষ্ট বিশেষ্য ব্যবহার করে বলেননি, সেই ১০ টি রাত।


আরবি ব্যাকরণের নিয়ম অনুযায়ী নাকিরা অর্থাৎ কোন শব্দের ক্ষেত্রে অনির্দিষ্ট বিশেষ্য ব্যবহার করার অর্থ হলো, সেই বিষয়টিকে বিশেষ সম্মান ও মর্যাদা দান করা।




জিলহজ মাসের ফজিলত - ইহকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দিন 


শর্তহীনভাবেই এই দিনগুলো পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ দিন। এর প্রত্যেকটি দিন, ঘন্টা, মিনিট আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয়। কেননা, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন—  


ইহকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দিন সমূহ হলো আইয়ামে আশর বা জিলহজের ১০ টি দিন।




জিলহজ মাসের আমল-জিহাদের চেয়েও অধিক প্রিয় 


নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন—  


মহান আল্লাহর কাছে বছরের অন্যান্য দিনে কৃত নেক আমল ততটা প্রিয় নয়, যতটা প্রিয় আইয়ামে আশর তথা জিলহজের দশটি দিনের নেক আমল। 




একথা শুনে সাহাবা রাযিয়াল্লাহু আনহুম জানতে চাইলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করাও কি এরচেয়ে উত্তম হবে না? উত্তরে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন—  


না, এমনকি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করাও এই দিনগুলোতে করা উত্তম আমলের সমতুল্য হবে না। তবে কেউ যদি নিজের জানমাল নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের উদ্দেশ্যে বের হয় আর জিহাদের ময়দানে জান ও মাল উভয়ই হারায় তাহলে তা আল্লাহর কাছে জিলহজের ১০ দিনে করা উত্তম আমলের চেয়ে অধিক প্রিয় বলে গণ্য হবে।

[সহিহ বুখারী : ৯৬৯]




হাদিসটি লক্ষ্য করুন, জিহাদের ময়দানে কেবল প্রাণ হারানোর কথা বলা হয়নি। আবার সম্পদ হারানোর কথাও বলা হয়নি। বরং জিহাদের ময়দানে যদি কেউ প্রাণ ও সম্পদ দুটোই হারায় কেবল তখনই তা উল্লেখিত ১০ দিনের উত্তম আমলের চেয়ে প্রিয় বলে গণ্য হবে।



ইমাম ইবনু তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ বলেন, জিলহজের ১০ টি দিন একনিষ্ঠ ভাবে রাত দিনে ইবাদতে নিমগ্ন থাকা ওই জিহাদের চেয়ে উত্তম, যে জিহাদে নিজের জান ও মাল কোনটাই বিনষ্ট হয়নি।

[আল-ফাতাওয়াল কুবরা লি ইবনি তাইমিয়া, খন্ড : ৫, পৃষ্ঠা : ৩৪২]




আমরা লক্ষ করলে দেখতে পাবো, আল্লাহ তায়ালা এই  দিনগুলোর জন্য কোন আমল ইবাদতকেই নির্দিষ্ট করে দেননি। এই দিনগুলো যেন বৃহৎ ও প্রশস্ত কোন পাত্রের মতো- যে পাত্র কেবল ইবাদত নয়, সম্ভাব্য যে কোন সৎ ও ভালো কাজ দ্বারা পূর্ণ করা সম্ভব। অর্থাৎ নির্দিষ্ট কোন ইবাদতকে নয়, বরং মর্যাদা দেওয়া হয়েছে এই দিনগুলোকে।




জিলহজ্জ মাসের ফজিলত এতটাই যে আপনি যদি আইয়ামে আশরে দশটি টাকা দান করেন, তাহলে শাবান, রমাদান অথবা শাওয়াল মাসে দশ টাকা দান করার চেয়েও তা আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় ও সাওয়াবের কাজ বলে গণ্য হবে। যদি আপনি এই দিনগুলোতে দুই রাকাত সালাত আদায় করেন তাহলে বছরের বাকি দিনগুলোতে আদায়কৃত অনুরূপ দুই রাকাত সালাতের চেয়ে তা আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় হবে। এভাবে অবশিষ্ট অনন্য সকল ভালো ও সৎ কাজের ক্ষেত্রে ও অনুরূপ তুলনা করা যায়।



ইবনু রজব রাহিমাহুল্লাহ বলেন, যেহেতু জিলহজের প্রথম ১০ দিনের আমল মহান আল্লাহর কাছে বছরের অনন্য দিনের আমলের চেয়ে প্রিয় ও সেরা, সেহেতু এই দিনগুলোতে আদায় করা অপেক্ষাকৃত কম মর্যাদার আমলও বছরের অনন্য দিনের উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন আমলের চেয়ে সেরা বলে বিবেচিত হবে।

[লাতায়িফুল মাআরিফু, পৃষ্ঠা : ৪৫৯]




অর্থাৎ যে সকল আমল মর্যাদার বিচারে হালকা ও ছোট, সেসব আমলও শ্রেষ্ঠ ও অধিক মর্যাদা সম্পন্ন বলে বিবেচিত হয়, যখন তা এই দিনগুলোতে আদায় করা হয়। মর্যাদাও শ্রেষ্ঠত্বের এই তারতম্য জিহাদের মত শ্রেষ্ঠ আমলের সাথে তুলনা দেখালেই বোঝা যায়।



ধরুন, স্বভাবত তাসবিহ পাঠ করা মর্যাদার দিক থেকে নফল সিয়াম পালনের চেয়ে ছোট। কিন্তু জিলহজের এই ১০ দিনে আপনি যদি তাসবীহ পাঠ করেন তবে তা বছরের অনন্য দিনের নফল সিয়ামের চেয়ে অধিক মর্যাদাসম্পন্ন বলে বিবেচিত হবে।





জিলহজ মাসের ১০ দিন কি পড়তে হয়?


জিলহজ মাসের ১০ দিন যা পড়তে হয় অর্থাৎ কুরআন ও হাদিসের আলোকে জিলহজ্জ মাসের আমলগুলো হলো- জিলহজ মাসের চাঁদ দেখার পর থেকে কোরবানি সম্পাদনের আগ পর্যন্ত নখ, চুল ও মোচ ইত্যাদি কাটা থেকে বিরত থাকা। ঈদের দিন বাদ দিয়ে জিলহজ্জের প্রথম ৯দিন রোজা রাখা। বিশেষ করে ৯ জিলহজ্জ আরাফার দিন রোজা রাখা। কুরবানী ফরজ হলে কুরবানী সম্পাদনা করা।জিলহজ মাসের পাঁচ দিন তাকবিরে তাশরিক আদায় করা আদায় করা। 


তাকবিরে তাশরিক হলো—


اَللهُ اَكْبَر اَللهُ اَكْبَر لَا اِلَهَ اِلَّا اللهُ وَ اَللهُ اَكْبَر اَللهُ اَكْبَر وَ للهِ الْحَمْد


উচ্চারণ : আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ।


এছাড়াও বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত, দোয়া দরূদ,  জিকির ও ইসতেগফার করা। 




জিলহজ মাসের ১০ দিনের তাকবীর কি?


আইয়ামে তাশরিকের দিনগুলোতে তাকবিরে তাকবির দেওয়া সুন্নতে মুআক্কাদাহ। তাকবির দুই প্রকার। একটি হলো সার্বক্ষণিক তাকবির, অন্যটি নির্দিষ্ট সময়ের তাকবির। 


সার্বক্ষণিক তাকবির হলো- আইয়ামে আশরের প্রথম দিন থেকে শুরু করে আইয়ামে তাশরিকের শেষ পর্যন্ত সবসময় যে তাকবির দেওয়া হয়।সাহাবিগণ এভাবেই জিলহজ্জ মাসের আমল করতেন। 



জিলহজ মাসের ১০ দিনের তাকবীর—


اَللهُ اَكْبَر اَللهُ اَكْبَر لَا اِلَهَ اِلَّا اللهُ وَ اَللهُ اَكْبَر اَللهُ اَكْبَر وَ للهِ الْحَمْد


উচ্চারণ : আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ।


অর্থ : আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান; আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই; আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান; সব প্রশংসা মহান আল্লাহ জন্য।





জিলহজ্ব মাসে কি কি করা যাবে না


জিলহজ্ব মাসে যে সব কাজ করা যাবে না তা হলো— জিলহজ মাসের চাঁদ দেখা গেলে যারা কুরবানির নিয়ত করেছেন তারা চুল, নখ ইত্যাদি কাটা থেকে বিরত থাকবে।এসব কাজ তারা জিলহজ মাসের চাঁদ দেখার আগে অর্থাৎ জিলকদ মাসে সম্পন্ন করবে।

 

কুরআন হাদিসের আলোকে জিলহজ্জ মাসের আমলের প্রথম আমল সম্পর্কে হজরত উম্মে সালমা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন—


যখন তোমরা জিলহজ মাসের চাঁদ দেখতে পাবে এবং তোমাদের কেউ কোরবানি করার ইচ্ছা করে তবে সে যেন চুল নখ কাটা থেকে বিরত থাকে। 

[ সহীহ মুসলিম, ইবনে হিব্বান]




শেষ কথা : পবিত্র জিলহজ্জ বরকতময় মাস। কুরআন হাদিসের আলোকে জিলহজ্জ মাসের আমল অনেক বেশি ফজিলতপূর্ণ। এ মাসের প্রতিটি আমল আল্লাহর কাছে অধিক পছন্দনীয়। পবিত্র জিলহজ্জ মাসেই মুসল্লিরা হজ্জ্ব পালনের উদ্দেশ্যে পবিত্র কাবা শরীফে একত্রিত হন, এবং হজ্জ্ব শেষে ঈদ-উল-আয্হা বা কুরবানীর ঈদ পালিত হয়। আল্লাহ তায়ালা সকল মুসলিম উম্মাহকে বরকতময় কুরআন হাদিসের আলোকে জিলহজ্জ মাসের আমল করার তাওফিক দান করুন ( আমিন )। 

Next Post Previous Post