মসজিদ নির্মাণ সম্পর্কে হাদিস ও কুরআন

মসজিদ মহান আল্লাহর ঘর। এবং মুসলিম জাতির মূলকেন্দ্র। এ ঘর আল্লাহ তায়ালার ইবাদতের উদ্দেশ্যে নির্মাণ করা হয়।এ কারণে রাসুল (সা.) হিজরতের প্রথম দিনই মসজিদ নির্মাণের কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন। মদিনায় হিজরতের সময় যাত্রাবিরতিকালে তিনি কুবা নামক স্থানে ইসলামের প্রথম মসজিদ নির্মাণ করেন। পরে মদিনায় পৌঁছে তিনি মসজিদ-ই-নববী স্থাপন করেন। এবং সেখান থেকেই ইসলামের জ্যোতি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেন। নিম্নে মসজিদ নির্মাণ সম্পর্কে হাদিস ও কুরআনের আলোকে আলোচনা করা হলো।








মসজিদ নির্মাণ সম্পর্কে হাদিস ও কুরআন


মসজিদ সম্পর্কে আয়াত


মসজিদ নির্মাণকারী ও রক্ষণাবেক্ষণকারী আল্লাহ তায়ালা কাছে খুবই পছন্দনীয়। মসজিদ নির্মাণ সম্পর্কে হাদিস ও কুরআনে বহু ফজিলতের ঘোষণা দিয়েছেন। এমনকি এটাকে ইমানদারদের বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন। 

 কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন—



إِنَّمَا يَعْمُرُ مَسَاجِدَ اللَّهِ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَأَقَامَ الصَّلَاةَ وَآتَى الزَّكَاةَ وَلَمْ يَخْشَ إِلَّا اللَّهَ ۖ فَعَسَىٰ أُولَٰئِكَ أَن يَكُونُوا مِنَ الْمُهْتَدِينَ


নিঃসন্দেহে তারাই আল্লাহর মসজিদ আবাদ করবে যারা ইমান এনেছে আল্লাহর প্রতি ও আখিরাতের প্রতি এবং যারা নামাজ প্রতিষ্ঠা করে ও জাকাত আদায় করে; আল্লাহ ব্যতীত আর কাউকে ভয় করে না। অতএব, আশা করা যায়, তারা সুপথপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।

[সুরা তাওবা, আয়াত  : ১৮]




উসমান ইবনু আফফান (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছেন—


যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য মসজিদ নির্মাণ করবে, মহান আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে অনুরূপ ঘর তৈরি করে দেবেন।

[সহীহ বুখারি : ৪৫০]




মসজিদ নির্মাণের সওয়াব মৃত্যুর পরও অব্যাহত থাকে। যত দিন সেই মসজিদে আল্লাহর ইবাদত হবে, তত দিন নির্মাণকারী এর সওয়াব পেতে থাকে।



আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—

 

‘মুমিনদের যেসমস্ত আমলের ধারা মৃত্যুর পরও চলমান থাকে তার মধ্যে অন্যতম হলো, ১. সেই ইলম (জ্ঞান) যা সে প্রসার করে গেছে। ২. রেখে যাওয়া নেক সন্তান। ৩. রেখে যাওয়া কুরআনের কপি। ৪. তার নির্মাণকৃত মসজিদ। ৫. তার নির্মাণ করে যাওয়া মুসাফিরখানা। ৬. তার স্থাপন করে যাওয়া নলকূপ। এবং ৭. ওই সাদাকা, যা বেঁচে থাকতে সে দান করে গেছে।’

[আল বাহরুজ জাখখার : ১৩/৪৮৪]





মসজিদ এমন একটি ঘর যে ঘরে মহান আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করে। সেখানে প্রবেশ করলে মুমিনের মন আল্লাহর ভালোবাসার সৌরভে প্রশান্ত হয়ে যায়। সেখানে মুমিনরা মহান আল্লাহর সঙ্গে কথোপকথনে লিপ্ত হয়। সেটি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্থান।



আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—


আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় জায়গা হলো মসজিদ আর সবচেয়ে নিকৃষ্ট জায়গা হলো বাজার।

[সহীহ মুসলিম : ১৪১৪]





মসজিদ নির্মাণের গুরুত্ব ও ফজিলত


মসজিদ নির্মাণের গুরুত্ব ও ফজিলতের কারণেই আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল কারিমে ২৮ জায়গায় এর আলোচনা করেছেন। আল্লাহ তায়ালা মসজিদকে তার নিজের দিকে সম্মানমূলক সম্মন্ধ করেছেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন—



وَأَنَّ الـْمَسَاجِدَ لله فَلا تَدْعُوا مَعَ الله أَحَدًا


নিশ্চয় মসজিদসমূহ আল্লাহরই জন্য। অতএব, তোমরা আল্লাহর সাথে কাউকে ডেকো না।

 [সুরা জিন, আয়াত : ১৮]




মসজিদে যেতে অভ্যস্ত ব্যক্তিকে ইমানদার হিসেবে সাক্ষ্য দিতে রাসুলুল্লাহ (সা.) নির্দেশ দিয়েছেন। আবু সাইদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন


যখন তোমরা কোনো মানুষকে দেখবে সে মসজিদের সাথে সম্পর্ক গড়ছে, তখন তোমরা তার ইমানের স্বীকৃতি দাও।’ এরপর তিনি এ আয়াত তিলাওয়াত করেন 


'নিঃসন্দেহে তারাই আল্লাহর মসজিদ আবাদ করবে যারা ইমান এনেছে আল্লাহর প্রতি ও আখিরাতের প্রতি এবং যারা নামায প্রতিষ্ঠা করে ও যাকাত আদায় করে...।'

[সুরা তাওবা, আয়াত : ১৮]




ইমাম কুরতুবি (রহ.) উপরোক্ত আয়াতের তাফসিরে বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা এ আয়াতে তাদেরকে মুমিন হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন, যারা সালাত আদায়ের মাধ্যমে মসজিদকে প্রাণবন্ত রাখবে, মসজিদকে পরিচ্ছন্ন রাখবে, মসজিদের সংস্কার কাজ করবে এবং সর্বোপরি আল্লাহর প্রতি ইমান আনবে।’



মসজিদ নির্মাণ সম্পর্কে কুরআনে মসজিদের সুরক্ষার জন্য আল্লাহ তায়ালা জিহাদকে বিধিবদ্ধ করেছেন। জিহাদ না থাকলে ইবাদাত ও মুয়ালাতের এ কেন্দ্রগুলোও টিকে থাকবে না।



 আল্লাহ তায়ালা বলেছেন


وَلَوْلَا دَفْعُ اللَّهِ النَّاسَ بَعْضَهُم بِبَعْضٍ لَّهُدِّمَتْ صَوَامِعُ وَبِيَعٌ وَصَلَوَاتٌ وَمَسَاجِدُ يُذْكَرُ فِيهَا اسْمُ اللَّهِ كَثِيرًا ۗ وَلَيَنصُرَنَّ اللَّهُ مَن يَنصُرُهُ ۗ إِنَّ اللَّهَ لَقَوِيٌّ عَزِيزٌ



আল্লাহ যদি মানবজাতির একদলকে অপর দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন তবে উপাসনালয়, গির্জা, প্যাগোডা ও মসজিদসমূহ বিধ্বস্ত হয়ে যেত, যেগুলাতে আল্লাহর নাম অধিক স্মরণ করা হয়। আল্লাহ নিশ্চয়ই তাদের সাহায্য করবেন, যারা আল্লাহর সাহায্য করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ শক্তিধর, পরাক্রমশালী।

[সুরা হজ, আয়াত : ৪০]




ইমাম কুরতুবি (রহ.) এ আয়াতের তাফসিরে বলেন, ‘আল্লাহ যদি নবিদের ওপর এবং মুমিনদের ওপর শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাকে ফরজ না করতেন তাহলে মুশরিকদের স্পর্ধা বেড়ে যেত এবং ইবাদাতের জন্য নির্দিষ্ট স্থানগুলোতে তারা বিঘ্নতা সৃষ্টি করতো। আর এ জন্যই আল্লাহ তায়ালা তাদের প্রতিহত করা আবশ্যক করেছেন, যেন নিরবচ্ছিন্নভাবে মানুষ আল্লাহর ইবাদাত করতে পারে।’



আল্লাহ তায়ালা বলেন


فِي بُيُوتٍ أَذِنَ اللَّهُ أَن تُرْفَعَ وَيُذْكَرَ فِيهَا اسْمُهُ يُسَبِّحُ لَهُ فِيهَا بِالْغُدُوِّ وَالْآصَالِ رِجَالٌ لَّا تُلْهِيهِمْ تِجَارَةٌ وَلَا بَيْعٌ عَن ذِكْرِ اللَّهِ وَإِقَامِ الصَّلَاةِ وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ ۙ يَخَافُونَ يَوْمًا تَتَقَلَّبُ فِيهِ الْقُلُوبُ وَالْأَبْصَارُ


আল্লাহ যেসব ঘরকে মর্যাদায় উন্নীত করার এবং সেগুলোতে তাঁর নাম উচ্চারণ করার আদেশ দিয়েছেন, সেখানে সকাল ও সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে; এমন লোকেরা, যাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ থেকে, নামাজ কায়েম করা থেকে এবং জাকাত প্রদান করা থেকে বিরত রাখে না। তারা ভয় করে সেই দিনকে, যেদিন অন্তর ও দৃষ্টিসমূহ উল্টে যাবে।

[সুরা নুর, আয়াত : ৩৭]





মসজিদে দান করার হাদিস


যদি কেউ একা একটি মসজিদ নির্মাণ করে, তার জন্য এই প্রতিদান। কিন্তু একা একটা মসজিদ নির্মাণ  তো সবার পক্ষে সম্ভব নয়, তাই যদি কেউ মসজিদ নির্মাণকার্যে অংশগ্রহণ করে, তাহলে তাদের জন্যও  রয়েছে প্রতিদান আল্লাহর পক্ষ থেকে।  



আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—


‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির নিমিত্তে পাখির বাসা পরিমাণ কিংবা তারচেয়েও ছোট মসজিদ নির্মাণ করবে আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে একটি প্রাসাদ নির্মাণ করবেন।’




আলিমগণ বলেছেন, ‘যারাই মসজিদ নির্মাণে অংশগ্রহণ করবে, প্রত্যেকেই প্রত্যেকের অংশগ্রহণের পরিমাণ অনুযায়ী প্রতিদান পাবে।’




শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ (রহ.) বলেন—


‘মসজিদ হলো উম্মাহর ইবাদাতগাহ ও মিলনকেন্দ্র। নবি (সা.) প্রতিষ্ঠিত মসজিদের কর্মসূচি ছিল সালাত, কিরায়াত, জিকির, নেতৃত্ব ও সামাজিক রীতিনীতি শিক্ষা। মুসলিমরা তাতে একত্রিত হতো তাদের ধর্মীয় ও বৈষয়িক যেকোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে।’



মসজিদ নির্মাণ সম্পর্কে হাদিস ও কুরআন ঘোষণা এসেছে  একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য মসজিদ নির্মাণ করতে হবে। কারো সেই সামর্থ্য না থাকলে কমপক্ষে সহযোগিতা করবে। মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণে আত্মনিয়োগ করবে। মসজিদকে সর্বদা পরিচ্ছন্ন ও সুগন্ধিময় করে রাখবে।



আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) পাড়ায় পাড়ায় মসজিদ নির্মাণ করার এবং তা পরিচ্ছন্ন ও সুগন্ধিময় রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। 

[আবু দাউদ : ৪৫৫]





মসজিদ নির্মাণ সম্পর্কে হাদিস ও কুরআনের আলোকে উক্ত আলোচনা থেকে এটা জানতে পারলাম যে,  মসজিদ নির্মাণ অত্যন্ত সওয়াবের কাজ এবং আল্লাহর প্রিয় হওয়ার মাধ্যম। মৃত্যুর পরেও এর সাওয়াব অব্যহত থাকবে। 



কিন্তু মসজিদ নির্মাণের শর্ত হলো— এতে কোনো রকমের অহমিকা, গৌরবের বিষয় অনুপ্রবেশ করতে দেওয়া যাবে না। মসজিদ নির্মাণের মাধ্যমে সমাজে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করা যাবে না। মসজিদ নির্মাণ করতে হবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। মসজিদ নিয়ে অহংকার করা কিয়ামতের আলামত। লোকেরা মসজিদ নিয়ে পরস্পর গৌরব ও অহংকারে মেতে না ওঠা পর্যন্ত কিয়ামত সংঘটিত হবে না। 

[আবু দাউদ : ৪৪৯]




সুতরাং মসজিদ নির্মাণকারী মসজিদ নিয়ে অহংকার করতে পারবেনা। কারণ এটি হলো কিয়ামতের আলামত। আল্লাহ তায়া’লা সবাইকে বোঝার তাওফিক দান করুন (আমিন)।

Next Post Previous Post