আইয়ামে জাহেলিয়া যুগের সাংস্কৃতিক অবস্থা

আইয়ামে জাহেলিয়া যুগে সাংস্কৃতিক অবস্থা আধুনিক যুগের মতো উর্বর না থাকলেও আরবরা সাংস্কৃতিক জীবন থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন ছিল না। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর আবির্ভাবের পূর্বে আরবসহ গোটা বিশ্বে ধর্মীয়,  সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা খুবই শোচনীয় এবং পাপ পঙ্কিলে পরিপূর্ণ ছিল। অন্যায়-অবিচার ,অনাচার-ব্যভিচার, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ,খুন-রাহাজানি, বঞ্চনা, প্রতারণা, লোভ-লালসা, ইত্যাদিতে সমাজ এবং জাতি ছিল নিমজ্জিত।এককথায়, মানুষ তখন অধঃপতনের শেষ সীমায় পৌঁছেছিল। 






হত্যা-লুণ্ঠন ও জিঘাংসাবৃত্তি চরিতার্থ করাই ছিল মানুষের নিত্যদিনের কাজ। নীতির নামে দুর্নীতি, শাসনের নামে শোষণ ও নির্যাতন ,ধর্মের নামে অধর্মের জয় জয়কার ছিল সর্বত্র, সাধারণ মানুষের জীবনে না ছিল কোন সুখ, না ছিল কোন স্বাচ্ছন্দ্য, না ছিল তাদের সামনে কোন আশার আলো। চারদিকে ছিল শুধু গাঢ় অন্ধকার।



আইয়ামে জাহিলিয়া বা অন্ধকার যুগ

আইয়ামে জাহেলিয়া আরবি শব্দ। আইয়াম শব্দের অর্থ সময় বা যুগ এবং জাহেলিয়া শব্দের অর্থ অজ্ঞতা বা তমসা অর্থাৎ অন্ধকার। আইয়ামে জাহেলিয়া বলতে তমসা বা অজ্ঞতার যুগ বা অন্ধকার যুগ বুঝায়।


ইসলামের ইতিহাসের ভাষায়, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর নবুওয়াত লাভের পূর্বে আরবের লোকেরাঐশী বাণীর অভাবে অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। তখন সমগ্র আরবে ধর্মীয় অনাচার , কুসংস্কার  এবং পূর্ণ অরাজকতা বিরাজ করছিল।  তারা নানা পাপাচারে আসক্ত ছিল। ব্যাপকভাবে সর্বত্র অত্যাচার-অনাচার, ব্যভিচার, চুরি, ডাকাতি, আত্মকলহ, হত্যা, ও রক্তপাত অপ্রতিহত গতিতে চলছিল। যা আইয়ামে জাহেলিয়া বা অন্ধকার যুগ নামে পরিচিত ছিল। 



আইয়ামে জাহেলিয়া যুগের সাংস্কৃতিক অবস্থা

বর্তমান যুগের ন্যায় আরবে প্রাক ইসলামী যুগে /আইয়ামে জাহেলিয়া যুগের  শিক্ষা ও সাংস্কৃতি বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষা পদ্ধতি, রুচিসম্মত ও মার্জিত জীবনধারা তথা উন্নত সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। মক্কা- মদীনা ও কয়েকটি শহর ছাড়া আরবরা প্রায়ই মূর্খ ও নিরক্ষর ছিল।  আইয়ামে জাহেলিয়া যুগের সংস্কৃতিক অবস্থা থেকে তারা একেবারে নিরবিচ্ছিন্ন ছিলোনা।  




তা সত্ত্বেও আইয়ামে জাহেলিয়া যুগের সংস্কৃতিক অবস্থা তেমন না থাকলেও আরবরা সাংস্কৃতিক জীবন থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন ছিল না।গীতিকাব্য রচনা, ভাস্কর্য নির্মাণে তারা দক্ষ ছিল। বার্ষিক ও উকাজের মেলায় তাদের সাংস্কৃতিক চর্চার আসর বসত। যৌনতা ,নারী ,যুদ্ধ ,বীরত্ব ও গৌরব গাথা ছিল তাদের সাহিত্যের বিষয়। সোনালী হরফে লেখা 'সাবা মুয়াল্লাকাত' বা ঝুলন্ত কাব্যমালা বা আইয়ামে জাহেলিয়া যুগের আরবি সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।তারা প্রবাদ প্রবচনও রচনা করত।  বাগ্মিতায় পারদর্শী ছিল।  তারা বংশতালিকা কন্ঠস্থ করতো। আবহাওয়া বিদ্যা ও ভবিষ্যৎবাণী বিদ্যায় দক্ষ ছিল।



প্রাক-ইসলামি যুগে আরব সাহিত্য চর্চায় খুবই উন্নত ছিল। প্রাচীন আরবি সাহিত্য তারই প্রমাণ বহন করে। হিট্টি বলেন, ' পৃথিবীতে সম্ভবত অন্য কোন জাতি আরবদের ন্যায় সাহিত্য চর্চায় এত বেশি স্বতঃস্ফূর্ত একাগ্রতা প্রকাশ করেনি।' তখনকার আরবে লিখন পদ্ধতি বিকাশের অভাবে গদ্য সাহিত্য রচনা সমৃদ্ধি লাভ করেনি । তবে যুদ্ধ-বিগ্রহ, বংশ বৃত্তান্ত ও গোত্র-কলহের ইতিহাস গদ্যে রচিত হয়েছিল। 



তখন আরবে সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন আরবি গীতিকবিতা বা কাসীদা ইতিহাসে অতুলনীয় । হিট্টি বলেন, ' মধ্যযুগে বহু শতাব্দী কাল পর্যন্ত আরবি ভাষা সভ্যজগতের শিক্ষা ও সংস্কৃতি  এবং উন্নতির একমাত্র মাধ্যম ছিল। ' তিনি আরো বলেন, ' কাব্যপ্রীতিই ছিল বেদুঈনদের সাংস্কৃতিক সম্পদ। '



প্রাক-ইসলামী যুগের কবি ও পন্ডিতদের মধ্যে ইমরুল কায়েস, লাবিদ, উম্মে কুলসুম, যুহাইর, হারিস, আনতারা,তারফা প্রমুখ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সাবা মুয়াল্লাকাত, দিওয়ানে হামাসা প্রভৃতি গ্রন্থের মাধ্যমে তখনকার গীতিকাব্য সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। তাদের কবিতার সাবলীলতা ও স্বচ্ছ  কাব্যবিন্যাস ছিল বৈশিষ্ট্যময়।



জাহেলিয়া যুগের কবিদের মধ্যে যশস্বী ছিলেন সাতটি ঝুলন্ত গীতিকাব্যের রচয়িতাগণ। সোনালী হরফে লিপিবদ্ধ এ-' সাবা মুয়াল্লাকাত' প্রাচীন আরব কবিদের অমর কীর্তি ছিল। এ যুগে অসংখ্য গাঁথা ও কাব্য সাহিত্য প্রণীত হয়। এগুলো আরব্য সংস্কৃতির অমূল্য সম্পদ। 



ইসলামের অভ্যুত্থানের পূর্বে আরব্য সাংস্কৃতিক জীবনে 'উকাজ মেলা ' বিশেষ গুরুত্বের দাবিদার ছিল। প্রতি বছর এ মেলা বসত।  এবং কাব্য নিয়ে কবিদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হত। এখানে বিভিন্ন বিষয়ের যেমন :- কাব্য, গাঁথা,  প্রবাদ, বীরত্ব ও বাগ্মিতার প্রতিযোগিতা হত এবং শ্রেষ্ঠ কবি ও কবিতা নির্বাচন করে শ্রেষ্ঠদের পুরস্কৃত করা হত। এ মেলায় গান-বাজনা, মদ, নারী, নৃত্য,  জুয়া-লটারী প্রভৃতির আসর বসত।



আরব যাযাবরেরা মরুভূমিতে নিজেদের জীবন কাটাত। তাই তাঁরা তারকা সমূহের নাম, গতি ও অবস্থান জানত।  আবার মৌসুমী আবহাওয়ার প্রভাবে কখন ঝড়-বৃষ্টি হতে পারে তাও বলতে পারতো। শহরের অনেকে তাদের কাছ থেকে সাধারণভাবে রোগের চিকিৎসা করে নিত। যাযাবরেরাও ঔষধ সম্পর্কে জ্ঞান রাখতো এবং তাঁরা বিশেষভাবে উটের চিকিৎসা জানতো।



আরব যাযাবরেরা ভবিষ্যদ্বাণী বিদ্যা জানতো। ভবিষ্যদ্বাণী বিদ্যা দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। 

  • প্রথমত , পায়ের চিহ্ন দেখে পথচারীর সন্ধান দেওয়া। 
  • দ্বিতীয়ত, শরীরের অঙ্গ ও গঠন দেখে বলা সে অমুক বংশের লোক।

এ দু'ধরনের বিদ্যায় আরবদের গভীর জ্ঞান ছিল। তাদের স্মরণশক্তি ছিল প্রখর। 




আইয়ামে জাহিলিয়া যুগের সামাজিক অবস্থা

আইয়ামে জাহেলিয়া যুগে অর্থাৎ ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে আরবের সামাজিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। বিভিন্ন পাপাচার, ব্যভিচার, দুর্নীতি, কুসংস্কার, অরাজকতা, অনাচার, ঘৃণ্য আচার-অনুষ্ঠান ও নিন্দনীয় কর্মকাণ্ডে সমাজ কলুষিত হয়ে পড়েছিল। গোত্র ভিত্তিক আরব সমাজের দুটো আলাদা শ্রেণী।  মরুবাসী বেদুইন ও শহরবাসী আরবদের জীবনযাত্রা প্রণালী ছিল একই সূত্রে গাঁথা। তাদের বৈবাহিক সম্পর্ক ও আচার অনুষ্ঠান ধ্যান-ধারণা ও রীতি-নীতি ছিল প্রায় একই রকম।
Next Post Previous Post